সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কাঁচা মরিচের রসগোল্লা আর গোলাকান্দাইল মেলার ঐতিহ্যের পরিচায়ক শত বছরের পুরনো রেসিপিতে পূতা বা বালিশ মিষ্টি তৈরি ও বিক্রির ধুম পড়েছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের তাঁতবাজার এলাকায়। চিনির বা গুড়ের রসে ভেজানো ময়দার গোলা কিংবা দুধ-চিনি মিশিয়ে তৈরি বিভিন্ন আকৃতির ছানায় তৈরী খাবার উপমহাদেশে মিষ্টি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে মিষ্টিকে পণ্য করে গড়ে তুলেছেন অগণিত নামী-দামী মিষ্টি-বিক্রয়কেন্দ্র। ময়রারা আদিযুগের লাড্ডু থেকে শুরু করে সন্দেশ, কালোজাম পেরিয়ে মিষ্টির প্রকারভেদকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

ভুলতার তাঁতবাজারস্থ ঢাকা সুইটস এন্ড বেকারীর মালিক আব্দুর রহিম বলেন, সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে মিষ্টির ব্যবহার অত্যন্ত প্রবল। ব্যাপক চাহিদা থাকায় এবার ঢাকা সুইটস এন্ড বেকারিতে মিষ্টির জগতে কাঁচা মরিচের ঝাঁজে সবুজ রঙের রসগোল্লা তৈরি করছি। পাশাপাশি পূতা মিষ্টি প্রেমীদের জন্য স্থানীয় ঐতিহ্য ধরে রাখতে এটি উৎপাদন করে বিক্রি করছি। গুনে মানে ভালো হওয়ায় ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এ ধরনের মিষ্টির।

মিষ্টি উৎপাদনকারী হাফেজ মাহমুদুল্লাহ বলেন, যারা কম মিষ্টির রসগোল্লা খেতে পছন্দ করেন, তারা এই মরিচ রসগোল্লার প্রধান ক্রেতা। আর গোলাকান্দাইল মেলায় শত বছর ধরে পূতা বা বালিশ মিষ্টি তৈরি হয়ে আসছিলো। সম্প্রতি সে মেলা বন্ধ হয়ে গেলে গ্রাহকদের মাঝে বালিশ বা পূতা মিষ্টির আগ্রহ ও চাহিদা তৈরি হয়। তাই পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে ভুলতা,গোলাকান্দাইল এলাকায় ময়রারা এ ধরনের মিষ্টি তৈরি করছেন। এতে ক্রেতাদর সাড়া পাওয়া গেছে।

ক্রেতা নুর শাহ মিয়া বলেন, সাধারণ রসগোল্লার চেয়ে কাঁচা মরিচের রসগোল্লার দাম একটু বেশি। ঢাকা সুইটস এর তিনটি শাখায় নতুন স্বাদের এ রসগোল্লা ক্রেতাদের আগ্রহ ভরে কিনে নিতে দেখা গেছে।

জানা যায়, রসগোল্লার ছানার সঙ্গে কাঁচা মরিচ মিশিয়ে চিনির শিরায় ডুবানো হয় এবং তৈরি করা হয় সবুজ রঙের রসগোল্লা। নতুন রকমের এ রসগোল্লা মুখে দিলে প্রথমে মিষ্টি, তারপর ধীরে ধীরে জিহ্বায় ঝাল স্বাদ পাওয়া যায়। এ ধরনের মিষ্টি উৎপাদনের পর ভুলতার তাঁতবাজার ঢাকা সুইটস’র দেখা গেছে ক্রেতাদের ভীর। গোলাকান্দাইলর এলাকার ক্রেতা জাহাঙ্গির মাহমুদ বলেন, ‘রসগোল্লা খেতে বেশ পছন্দ করি। কাঁচা মরিচের রসগোল্লার কথা শুনে কিনতে এসেছি। দাম একটু বেশি মনে হলো তবে সুস্বাদু এটি।

মিষ্টি তৈরির কারিগর মাকসুদুর রহমান বলেন, ঢাকা সুইটস স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে মিষ্টি উৎপাদন করে। এর প্রধান শো রূম তাঁতাবাজার। বাকি আরো ২ টির একটি বরপা অপরটি রূপসীতে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কাঁচা মরিচের রসগোল্লা তৈরি করলে ব্যাপক চাহিদা পাওয়া যায়। ঝাল ফ্লেভারের নতুন ধরনের সবুজ রঙের মিষ্টি হওয়ায় দিনে দিনে এর চাহিদা বাড়ছে। মিষ্টির দোকানিরাও পাইকারি কিনে নিতে আসেন। তিনি বলেন, ‘গত ৫ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। এর আগে গাজর, মসলা, হিমসাগর আমের রসে রসগোল্লা তৈরি করেছি। বালিশ মিষ্টির একেকটার ওজন দুই কেজিরও বেশি। আর আকার হয়ে থাকে তিন ইঞ্চি থেকে পনেরো ইঞ্চি বা শোয়া ফুট লম্বা। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন আকারের মিষ্টি তৈরি করা হয়। এজন্য দামেও থাকে ভিন্নতা। একটি বালিশ মিষ্টির দাম সর্বনিম্ন ২শ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। তৈরির উপাদান ও কৌশলগত কারণে বালিশ বা পূতা মিষ্টির স্বাদ ও মান অতুলনীয়।

কলামিস্ট লায়ন মীর আব্দুল আলীম বলেন, মিষ্টি পছন্দ করেন না এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলই কোনো না কোন কারনে বিখ্যাত। গোলাকান্দাইলের মেলায় তৈরা হওয়া শত বছরের পুরনো রেসিপিতে বালিশ মিষ্টি এখনো বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
প্রবীন সাংবাদিক ও কবি আলম হোসেন বলেন, জমিদার আমল থেকে গোলাকান্দাইল এলাকায় পূতা বা বালিশ মিষ্টি তৈরি হয়ে আসছে। সে সময়ের ময়রাদের রেসিপি শিখে রেখেছিলেন গিয়েছিলেন বংশধর, কর্মচারী ও শিষ্যরা। তখন থেকে এখনো পর্যন্ত সেই প্রক্রিয়ানুযায়ী আকৃতি, স্বাদ, মান ও রং ঠিক রেখেই বানানো হয় পূতা বা বালিশ মিষ্টি।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ বিশেষ মিষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছেন সেখানকার ময়রারা। তাদের নিষ্ঠা ও সৃজনশীলতায় ঐতিহ্যবাহী সেসব মিষ্টি‘র মধ্যে আছে-ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মন্ডা, নাটোরের কাঁচাগোল্লা,টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই , বিক্রমপুর ও কলাপাড়ার রসগোল্লা, বগুড়ার দই, যশোরের খেজুরগুড়ের সন্দেশ, শাহজাদপুরের রাঘবসাই, পানতোয়াঅ, খুলনা ও মুন্সিগঞ্জের অমৃতি, নওগাঁর প্যারা সন্দেশ, ময়মনসিংহের অমৃতি, মালাইকারী এবং চালের জিলাপি যশোরের জামতলার মিষ্টি মেহেরপুরের সাবিত্রী মিষ্টি, যশোরের নলেন গুড়ের প্যারা সন্দেশ গুঠিয়ার সন্দেশ, সিরাজদিখানের পাতক্ষীর, রাজবাড়ীর চমচম, নওগাঁর রসমালাই , কুষ্টিয়ার মহিষের দুধের দই, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানা ইত্যাদি পরিচিত। তেমনি প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জ ও প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁও অঞ্চলে‘র ময়রাদের প্রাচীনতম রেসিপির আদলে স্থানীয় মিষ্টির দোকানে হরেক রকম বাহারী মিষ্টি পাওয়া যায় অতি সুলভে।